এক সময়ের মাটি পোড়া ইটের (ইটের পাঁজা) ব্যবসায়ী, এখন কংক্রিট ব্লকের সফল উদ্যোক্তা

জনাব মারুফ হোসেন শেখ ১৯৯৬ সালে সরকারি পিসি কলেজ, বাগেরহাট থেকে স্নাতক পাস করেন, লেখাপড়া শেষ করে একটি লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে তিন বছর চাকরি করেন। কিন্তু চাকরির প্রতি তার তেমন আকর্ষন ছিলো না। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৩ জন। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার এবং এ চিন্তা থেকেই শুরু করেন মাটি পোড়া ইট ও বালির ব্যবসা নিজ এলাকা ধলনগর, কচুয়া, বাগেরহাট। কিছুদিন পর তার ব্যবসাকে তিনি সম্প্রসারিত করেন, যুক্ত করেন নিজ এলাকায় বড় করে ইটের পাঁজা তৈরি করে কাঠ পুড়িয়ে সেই ইট তৈরি ও বিক্রয় করা। এই ব্যবসা তিনি পাঁচ বছর চলমান রাখেন। তার ব্যবসা ভালোই চলছিল হঠাৎ একদিন প্রশাসন থেকে তার ইটের পাঁজা এবং প্রস্তুতকৃত প্রায় ২০০০০০ ইট ও কাঁচামাল হিসাবে প্রায় ২১০০ মন কাঠ বাজেয়াপ্ত করে তাকে জেল ও জরিমানা করেন। জেল থেকে বের হয়ে মারুফ হোসেন উপলব্ধি করেন আইনবিরোধী কোন ব্যবসা আর করবেন না। তাই তিনি পুনরায় স্বল্প পরিসরে রুপসা থেকে ভাটায় পোড়া ইট ক্রয় করে বিক্রয় ও পাশাপাশি বালির ব্যবসা চলমান রাখেন। এমতাবস্থায় তিনি তার ব্যবসা ও আয় বৃদ্ধির জন্য নতুন কোন আয়ের উৎস খুঁজতেছিলেন। ইন্টারনেটের সহায়তায় বিভিনড়ব নতুন ব্যবসার আইডিয়ার মাঝে ব্লক তৈরির ব্যবসাটি তার পছন্দ হয়। কিন্তু এই ব্যবসা বা মেশিন সম্পর্কে তার কোন ধারণা না থাকায় বা কোন জায়গা থেকে ক্রয় করা যাবে এই তথ্য না থাকায় তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি এই ব্যবসা শুরু করতে পারছিলেন না।

এমন সময় ২০২২ সালে কোডেক এসইপি প্রকল্পের একজন উদ্যোক্তা ও ব্লক মিস্ত্রি জনাব মাহবুব আলমের সাথে তার পরিচয় হয়, জনাব মাহবুব আলমের পরামর্শে তিনি একটি হাতের তৈরি ফর্মা দিয়ে ব্লক তৈরি শুরু করেন। তারপর কোডেক এসইপি প্রকল্প জনাব মারুফ শেখ কে প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ প্রদান করেন, কারিগরি সহায়তা প্রদান করেন, প্রচার প্রচারণার জন্য তাকে বিভিন্ন রকম ব্যানার ও একটি সাইনবোর্ড তৈরি করে দেন, পাশাপাশি তাকে কয়েকজন উদ্যোক্তার মেশিন ও উৎপাদন বাস্তবে পরিদর্শন করানো হয় যাতে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা তৈরি হয় এবং উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠে। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জনাব মারুফ শেখ হাতের তৈরি ফর্মা দিয়ে প্রায় ৫০০০ ব্লক তৈরি করেছিলেন যার মধ্যে প্রায় তিন হাজার ব্লক বিক্রয় হয়ে গিয়েছে। বাগেরহাটের বেমরতা ইউনিয়নে মাদ্রাসা বাজার এলাকায় দুইটি বেডরুম, একটা ড্রয়িং রুম ও কিচেন, বাথরুমসহ ছাদওয়ালা একটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ির সম্পূর্ণ কাজ তার হলোব্লক দিয়ে সম্পন হয়েছে, বাড়িটির ঠিকাদার ছিলেন প্রকল্পের সেই উদ্যোক্তা জনাব মাহবুব আলম যিনি মারুফ হোসেনকে এই ব্লক তৈরীর পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রকল্পের দুইজন উদ্যোক্তার মাধ্যমে এলাকায় দৃষ্টিনন্দন একটি বাড়ি হওয়ায় এই এলাকাবাসী এখন পরিবেশবান্ধব ব্লক সম্পর্কে অবগত এবং সচেতন। পাশাপাশি এলাকার মসজিদের ইমাম তাকে জানান সৌদি আরব থাকতে তিনি ব্লকের ব্যবহার দেখেছেন তাই তাকেও কিছু ব্লক তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। জনাব মারুফ হোসেন জানান বর্তমানে তিনি হলোব্লকের অনেক অর্ডার পাচ্ছেন। এলাকাবাসী কৌতূহলবশত তার ফ্যাক্টরি ভিজিট করছে এবং স্থানীয় জনগণ তার এই কাজকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। তার ব্যবসা সম্প্রসারনের জন্য তিনি কোডেক ক্ষুদ্র ঋণ কার‌্যক্রম থেকে ২৪০০০০ টাকা ঋণ নিয়ে বেশি করে পণ্য উৎপাদন করেন। ‍সেই সময়ে তার মাসিক আয় ছিল ১৫০০০-২০০০০ টাকা। প্রকল্প থেকে মেশিন ক্রয়ে অনুদান সহায়তা, স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান ও অনলাইনে ব্যবসার প্রচার করা হয়েছে। ফলে তিনি ম্যানুয়াল মেশিন বাদ দিয়ে সেমি অটোমেটিক মেশিন ক্রয় করতে পেরেছেন। আমাদের প্রচারনায় সম্প্রতি তিনি একটি মাদ্রাসা নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্লকের অর্ডার পান। বর্তমানে তিনি ৪৫০০০-৫০০০০ টাকা মাসিক আয় করছেন। চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় শুরু করা, সরকার মালামাল বাজেয়াপ্ত করায় পুঁজি শূন্য হয়ে পড়া, অভিজ্ঞতা ছাড়া ব্লক ব্যবসা শুরু করার মতো বড় বড় চ্যালেঞ্জ থাকলেও প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তির জন্য হার না মেনে নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রমান করেছেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, কোডেক-এসইপি প্রকল্পের সহযোগিতা ও পরামর্শে তার ব্যবসার প্রচার-প্রসার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন পরিবেশগত চর্চা অনুশিলন করায় কর্মীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমেছে, কারখানার মান উন্নয়ন হয়েছে।